প্রাণীরা কি ভূমিকম্পের আগাম সংকেত টের পায়? যা বলছে গবেষণা
প্রতিক্ষণ ডেস্ক
প্রাণীরা ভূমিকম্পের আগাম ইঙ্গিত পেতে পারে—এ ধারণা বহুদিনের। প্রাচীন ইতিহাস, লোককথা আর আধুনিক অভিজ্ঞতা মিলিয়ে এই বিশ্বাস এখনো টিকে আছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে প্রাণীরা সত্যিই ভূমিকম্প আগে থেকে বুঝতে পারে কি না—এ প্রশ্নের পুরোপুরি উত্তর গবেষকেরা এখনো দিতে পারেননি। তবুও সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বিষয়টিকে নতুনভাবে আলোচনায় এনেছে।
ইতিহাসের পুরোনো নথিতে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৩ সালে গ্রিসে বড় ভূমিকম্পের আগমুহূর্তে ইঁদুর, সাপ, বেজি ও বিছার মতো প্রাণীরা বাসস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ ধরনের বর্ণনা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ছড়ানো। আধুনিক যুগেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভূমিকম্পের আগে প্রাণীদের অস্বাভাবিক আচরণের অনেক ঘটনাই প্রকাশিত হয়। তবে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন—গুজব, অভিজ্ঞতা বা গল্প এক ধরনের বিষয়, আর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বিজ্ঞান বলছে, ভূমিকম্পের আগে দুটি ধরনের কম্পন সৃষ্টি হয়—প্রথমে ছোট ‘পি-ওয়েভ’, যার পর আসে বড় ‘এস-ওয়েভ’। মানুষ সাধারণত ‘এস-ওয়েভ’-এর ধাক্কাই অনুভব করে, কিন্তু ‘পি-ওয়েভ’ অত্যন্ত দুর্বল হলেও প্রাণীরা তা টের পেতে পারে। তাদের ঘ্রাণ, স্পর্শ বা শ্রবণশক্তি অনেক সূক্ষ্ম বলে তারা ভূমিকম্পের কয়েক সেকেন্ড আগে অস্থির হয়ে উঠতে পারে। তবে এই সতর্কতা খুবই স্বল্পসময়ের—এটি ঘণ্টা বা দিন আগে কোনো সংকেত দেয় না।
প্রাণীর আচরণ নিয়ে সংগঠিত পর্যবেক্ষণ প্রথম শুরু হয় চীনে। ১৯৬৬ সালে শিনতাই ভূমিকম্পে হাজারো মানুষের মৃত্যু হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা ব্যাপকভাবে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করেন। অনেকেই দাবি করেন, ভূমিকম্পের আগেই প্রাণীদের অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করেছিলেন। এরপর সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম প্রাণী–পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, যেখানে কুকুর, বানর, মুরগি, ইঁদুরসহ বিভিন্ন প্রাণীর আচরণ নিয়মিতভাবে নথিবদ্ধ করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়—কখনো প্রাণীরা আগাম অস্বাভাবিক আচরণ করলেও এর ধারাবাহিক প্রমাণ মেলেনি।
ইতালিতে পরিচালিত এক আধুনিক গবেষণা বিষয়টিকে আবার নতুন করে আলোচনায় আনে। জার্মান গবেষক মার্টিন ভিকেলস্কি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় কিছু গরু, ভেড়া ও কুকুরের শরীরে সেন্সর লাগিয়ে কয়েক মাস পর্যবেক্ষণ করেন। দেখা যায়—বড় ভূমিকম্পের প্রায় ২০ ঘণ্টা আগে এসব প্রাণীর সক্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে এই তথ্য ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতেও সহায়ক হয়। তবে সব বিজ্ঞানী এই ফলাফলকে নিশ্চিত প্রমাণ মানতে রাজি নন। তাদের যুক্তি—প্রাণীর আচরণ পরিবেশগত আরও অনেক কারণে পরিবর্তিত হতে পারে।
অনেক গবেষণায় ১৬০টির বেশি ভূমিকম্পের আগে প্রাণীর ৭০০টিরও বেশি অস্বাভাবিক আচরণের নথি পাওয়া গেলেও এখনো এটি নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাস পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তবুও প্রবৃত্তির দিক থেকে প্রাণীরা পরিবেশের ক্ষুদ্রতম পরিবর্তন—যেমন বায়ুচাপ, শব্দ, গন্ধ বা কম্পন—মানুষের চেয়ে দ্রুত শনাক্ত করতে পারে। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে তাদের আচরণে পরিবর্তন দেখা নতুন কিছু নয়। আগুন লাগলে পাখির উড়ে যাওয়া, ঝড়ের আগে পোকামাকড়ের গর্তে ঢুকে পড়া কিংবা সুনামির আগে বন্যপ্রাণীদের উঁচু জায়গায় চলে যাওয়া—এসবই তাদের স্বাভাবিক বিবর্তিত বাঁচার কৌশল।
ভবিষ্যতে প্রাণীর আচরণ কি ভূমিকম্প সতর্কতা ব্যবস্থার অংশ হতে পারে? বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এখন প্রাণীদের ওপর সেন্সর লাগিয়ে রিয়েল-টাইম ডেটা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। কেউ কেউ মনে করছেন—একদিন এটি প্রযুক্তিনির্ভর আগাম সতর্কবার্তার অংশ হতে পারে। তবে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন—এটি এখনো প্রমাণিত নয়, তাই প্রাণীর আচরণকে একমাত্র পূর্বাভাস হিসেবে গ্রহণ করা ঝুঁকির।
সার্বিকভাবে বলা যায়—প্রাণীরা ভূমিকম্প পুরোপুরি আগাম টের পায়, এমন চূড়ান্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখনো নেই। তবে গবেষণার অগ্রগতি ও শত শত বছরের অভিজ্ঞতা ইঙ্গিত দেয়—এই বিষয়টি ভবিষ্যতে আরও নতুন গবেষণার দরজা খুলে দিতে পারে।
তথ্যসূত্র: সায়েন্স ডিরেক্ট, বিবিসি, টিআরটি ওয়ার্ল্ড














